ডায়রিয়া কেন হয় এবং কিভাবে প্রতিরোধ করবেন?

ডায়রিয়া, বা পাতলা পায়খানা, একটি সাধারণ কিন্তু অস্বস্তিকর স্বাস্থ্য সমস্যা যা জীবনের কোনো না কোনো সময়ে প্রায় সবাইকেই প্রভাবিত করে। এটি প্রতিদিন তিন বা তার বেশি বার ঢিলে বা পানির মতো মলত্যাগ দ্বারা চিহ্নিত হয় এবং এটি কয়েক দিন স্থায়ী হতে পারে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি সাময়িক এবং তুলনামূলকভাবে নিরীহ, দীর্ঘস্থায়ী বা গুরুতর ডায়রিয়া মারাত্মক পানিশূন্যতা এবং অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

ডায়রিয়ার কারণ

ডায়রিয়া হজম প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সমস্যা থেকে হতে পারে। সাধারণ কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:

১. সংক্রমণ

ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, এবং পরজীবী দ্বারা সংক্রমণ ডায়রিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। উদাহরণস্বরূপ, খাবার-দূষণকারী ব্যাকটেরিয়া যেমন সালমোনেলা বা ই. কোলাই ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। ভাইরাস যেমন রোটাভাইরাস এবং নোরোভাইরাসও এই অবস্থার জন্য দায়ী। পর্যটনকালে, অপরিচিত জল বা খাবার গ্রহণের ফলে ‘ট্রাভেলার্স ডায়রিয়া’ হতে পারে।

২. খাবারের অসহিষ্ণুতা

যারা নির্দিষ্ট খাবার যেমন দুধে থাকা ল্যাকটোজ হজম করতে পারে না, তাদের খাবার গ্রহণের পর ডায়রিয়া হতে পারে।

৩. ওষুধ

কিছু ওষুধ, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক, অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট করে ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

৪. হজমজনিত সমস্যা

আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম), ক্রোহন’স ডিজিজ, সেলিয়াক ডিজিজ, এবং অতিসক্রিয় থাইরয়েড গ্রন্থি সহ কয়েকটি দীর্ঘস্থায়ী হজমজনিত সমস্যা ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে।

৫. মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ

বেশ কিছু মানুষ মানসিক চাপের সময় হজমের সমস্যা অনুভব করে, যার মধ্যে ডায়রিয়াও অন্তর্ভুক্ত।

উপসর্গ

ডায়রিয়ার লক্ষণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:

  • দিনে তিন বা ততোধিক বার ঢিলে বা পানির মতো মলত্যাগ

  • পেট ব্যথা বা ক্র্যাম্প

  • বমি বমি ভাব বা বমি

  • জ্বর

  • রক্ত বা শ্লেষ্মাযুক্ত মল

  • মলদ্বারের চারপাশে জ্বালা

  • পানিশূন্যতার লক্ষণ, যেমন মুখ শুকিয়ে যাওয়া, গা ঘোরানো, এবং কম পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত

যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ নিচের কোনো লক্ষণ লক্ষ্য করেন, তবে অবিলম্বে চিকিৎসা সহায়তা নিন:

  • ৩ দিনের বেশি স্থায়ী ডায়রিয়া

  • রক্তযুক্ত বা কালো রঙের মল

  • উচ্চ তাপমাত্রা (১০২°F বা তার বেশি)

  • তীব্র পেট ব্যথা বা ক্র্যাম্প

  • গুরুতর পানিশূন্যতার লক্ষণ (চোখ বসে যাওয়া, অতিরিক্ত পিপাসা, গা ঘোরানো)

ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী

কয়েকটি গোষ্ঠী ডায়রিয়ার কারণে গুরুতর জটিলতার বেশি ঝুঁকিতে থাকে:

  • শিশু: ডায়রিয়া শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ হতে পারে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে।

  • বয়স্ক ব্যক্তি: বার্ধক্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকায় জটিলতার ঝুঁকি বেশি।

  • দুর্বল ইমিউন সিস্টেমযুক্ত ব্যক্তি: ক্যান্সার, এইচআইভি/এইডস, বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনকারী রোগীরা।

  • ভ্রমণকারীরা: অপরিচিত অঞ্চলে থাকা খাবার বা পানির কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে।

ঘরোয়া প্রতিকার

মৃদু ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে ঘরোয়া প্রতিকার কার্যকর হতে পারে:

১. হাইড্রেশন

  • প্রচুর পানি পান করুন

  • ওআরএস (ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন) গ্রহণ করুন

  • ডাবের পানি বা খেলো লবণ-চিনি পানিও উপকারী

২. বিআরএটি (BRAT) ডায়েট

  • কলা (Bananas), ভাত (Rice), আপেল সস (Applesauce), টোস্ট (Toast)

  • হালকা খাবার যা পেটের জন্য সহনীয়

৩. প্রোবায়োটিক

  • দই বা প্রোবায়োটিক সম্পূরক অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়া ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে

৪. চিনি ও চর্বি এড়িয়ে চলুন

  • বেশি চিনি বা চর্বিযুক্ত খাবার ডায়রিয়া বাড়িয়ে দিতে পারে

চিকিৎসা

১. ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ

  • Loperamide (Imodium): মলত্যাগের সংখ্যা কমাতে সাহায্য করে

  • Bismuth subsalicylate (Pepto-Bismol): ব্যাকটেরিয়াজনিত বা ভ্রমণকালীন ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক

২. অ্যান্টিবায়োটিক

  • যদি সংক্রমণ ব্যাকটেরিয়াজনিত হয় এবং গুরুতর হয়

৩. চিকিৎসা নিরীক্ষা

  • দীর্ঘস্থায়ী বা পুনরাবৃত্ত ডায়রিয়ার জন্য রক্ত পরীক্ষা, মল পরীক্ষা বা অন্ত্রের পরীক্ষা প্রয়োজন হতে পারে

প্রতিরোধ

ডায়রিয়া প্রতিরোধে কয়েকটি সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করা যেতে পারে:

১. ভালো হাইজিন বজায় রাখা

  • খাবার আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পর ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া

২. নিরাপদ পানি পান করা

  • বোতলজাত বা ফুটানো পানি ব্যবহার করুন

  • বরফ এড়িয়ে চলুন যদি না আপনি জানেন এটি নিরাপদ পানি দিয়ে তৈরি

৩. নিরাপদ খাবার নির্বাচন

  • রাস্তার খাবার, অপরিচ্ছন্ন ফলমূল এবং অপচিকিৎসা করা মাংস এড়িয়ে চলুন

৪. ভ্যাকসিন

  • শিশুদের জন্য রোটাভাইরাস ভ্যাকসিন

  • পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলে কলেরা বা টাইফয়েড ভ্যাকসিন প্রয়োজন হতে পারে

খাবার যা খেতে হবে এবং এড়াতে হবে

খেতে হবে:

  • কলা, সাদা ভাত, টোস্ট, সিদ্ধ আলু

  • ক্লিয়ার স্যুপ, ওআরএস, ডাবের পানি

  • প্রোবায়োটিক জাতীয় খাবার (যেমন: দই)

এড়াতে হবে:

  • দুগ্ধজাত খাবার (যদি সহ্য না হয়)

  • ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল

  • মসলাদার ও চর্বিযুক্ত খাবার

  • উচ্চ চিনি সমৃদ্ধ পানীয় ও খাবার

ডায়রিয়া সাধারণত নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়, তবে যদি এটি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা গুরুতর হয়, তবে এটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। প্রতিরোধের মূলমন্ত্র হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপদ খাবার ও পানির ব্যবহার এবং প্রয়োজনে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ। একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি পান এবং মানসিক চাপ কমিয়ে রাখা ডায়রিয়া প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। সতর্ক থাকলে এবং প্রাথমিক পদক্ষেপ নিলে এই সাধারণ সমস্যাটিকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

 

Suggest for You